ব্রাশ করার সময় বমি বমি ভাব হয় কেন
সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে গেলেই অনেকের মুখে বমি বমি ভাব আসে। এমনকি কারও ক্ষেত্রে হালকা বমি পর্যন্ত হতে পারে। এটি অনেকের কাছে অস্বস্তিকর এবং বিরক্তিকর একটি অভিজ্ঞতা। প্রশ্ন হলো—এই অনুভূতির কারণ কী? এটি কি স্বাভাবিক? না কি কোনো শারীরিক সমস্যার লক্ষণ?
এই আর্টিকেলে আমরা বিস্তারিতভাবে জানবো ব্রাশ করার সময় বমি বমি ভাব হওয়ার কারণ, সম্ভাব্য শারীরিক কারণ, চিকিৎসা পদ্ধতি এবং প্রতিকার।
🤢 ব্রাশ করতে গিয়ে কেন বমি বমি ভাব আসে?
প্রধান কারণ হলো gag reflex, বাংলায় যাকে বলে “ওগরণ প্রতিক্রিয়া”। এটি শরীরের একটি প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া, যার কাজ হলো মুখ ও গলার ভিতরে অস্বাভাবিক কিছু প্রবেশ করলে তা শরীর থেকে বের করে দেওয়া। এটি মূলত আমাদের গলার পেছনের অংশ (pharynx), জিভের পেছনের অংশ, এবং soft palate এর মধ্যে ঘটে থাকে।
🎯 মূলত নিচের কারণগুলো এই সমস্যা তৈরি করে:
-
Gag Reflex অতিসংবেদনশীল হওয়া
কারও কারও gag reflex খুব সংবেদনশীল হয়, যার ফলে দাঁতের ব্রাশ জিভ বা গলার কাছে গেলেই শরীর প্রতিক্রিয়া দেয় এবং বমি বমি ভাব হয়। -
জিভ পরিষ্কার করার সময় চাপ
দাঁত ব্রাশ করার সময় অনেকেই জিভ পরিষ্কার করতে গিয়ে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করেন, যা গলার কাছাকাছি চলে যায় এবং gag reflex সক্রিয় হয়। -
খালি পেটে থাকা
অনেক সময় সকালে খালি পেটে ব্রাশ করলে পেটে থাকা অ্যাসিড মুখে উঠে আসে এবং বমি বমি ভাব হয়। যারা গ্যাস্ট্রিক বা অ্যাসিডিটির সমস্যায় ভোগেন, তাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়। -
অতিরিক্ত ফ্লেভারড টুথপেস্ট
কিছু কিছু মেন্টহল বা ঝাঁঝালো টুথপেস্ট মুখের স্বাভাবিক শ্লেষ্মা উত্তেজিত করে এবং বমি বমি ভাব তৈরি করতে পারে। -
মনে ভয় বা অভ্যাসগত সমস্যা
অনেকে মনে করে যে ব্রাশ করলে বমি আসবেই—এই মানসিক প্রস্তুতি থেকেই শরীর প্রতিক্রিয়া দিতে শুরু করে। যাকে বলে Psychogenic Gag Reflex।
⚠️ কোন কোন ক্ষেত্রে এটি সমস্যাজনক?
ব্রাশ করার সময় বমি বমি ভাব মাঝে মাঝে হলে এটি খুব বড় সমস্যা নয়। তবে নিম্নলিখিত উপসর্গগুলো দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত:
-
প্রতিদিন বমি হওয়া
-
মুখে খারাপ স্বাদ থাকা বা মুখ শুকিয়ে যাওয়া
-
পেট ব্যথা, অ্যাসিড রিফ্লাক্স বা গ্যাসের সমস্যা
-
ব্রাশ করার ভয় বা অস্বস্তি এতটাই বেশি হওয়া যে দাঁত পরিষ্কার করাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে
🩺 কীভাবে সমস্যার প্রতিকার করা যায়?
✅ ১. সঠিকভাবে ব্রাশ করুন
-
ব্রাশ করার সময় খুব জোরে ব্রাশ দিবেন না।
-
জিভ পরিষ্কার করার সময় খুব গভীরে যাবেন না।
-
নরম ব্রিসলযুক্ত টুথব্রাশ ব্যবহার করুন।
✅ ২. হালকা ফ্লেভারযুক্ত টুথপেস্ট ব্যবহার করুন
ঝাঁঝালো মেন্টহলযুক্ত টুথপেস্ট এড়িয়ে চলুন। এর পরিবর্তে হালকা সুগন্ধযুক্ত বা শিশুদের ব্যবহৃত টুথপেস্ট ব্যবহার করতে পারেন।
✅ ৩. সকালে কিছু খেয়ে তারপর ব্রাশ করুন
সকালবেলা খালি পেটে ব্রাশ না করে হালকা কিছু খেয়ে নিতে পারেন যেমন—একটু পান বা বিস্কুট। এতে গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিড মুখে উঠে আসবে না।
✅ ৪. ধীরে ধীরে জিভ পরিষ্কার করার অভ্যাস করুন
প্রথমে জিভের সামনের অংশ পরিষ্কার করুন, ধীরে ধীরে একটু গভীরে যান। এতে gag reflex ধীরে ধীরে সহনশীল হয়ে ওঠে।
✅ ৫. নাক দিয়ে শ্বাস নিন
ব্রাশ করার সময় মুখ দিয়ে শ্বাস না নিয়ে নাক দিয়ে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করুন। এতে gag reflex অনেকটাই কম হয়।
✅ ৬. মনোসংযোগ পরিবর্তন করুন
ব্রাশ করার সময় গান শোনা, দাঁড়িয়ে টিভি দেখা বা অন্য কিছুতে মনোযোগ রাখলে মন ভয় থেকে বেরিয়ে আসে এবং বমি ভাব কমে।
✅ ৭. Gag Reflex নিয়ন্ত্রণে কিছু ব্যায়াম
-
প্রতিদিন জিভের পেছনের অংশে আঙুল বা ব্রাশের নরম অংশ দিয়ে হালকা স্পর্শ করে ধীরে ধীরে সহনশীলতা তৈরি করতে পারেন।
-
১-২ সপ্তাহের অনুশীলনে gag reflex অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
🍀 ঘরোয়া কিছু উপায়
-
ব্রাশের আগে গরম পানি দিয়ে কুলি করুন, এতে মুখের পেশি আরাম পায়।
-
আদা বা পুদিনার রস মুখে দিলে বমি ভাব কমে।
-
ব্রাশ করার পর এক চা চামচ মধু খেলে মুখে তৃপ্তি আসে এবং বমি ভাব দূর হয়।
👩⚕️ কখন চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি?
যদি আপনার gag reflex অতিরিক্ত সক্রিয় হয় এবং কোনওভাবেই তা কমানো না যায়, তাহলে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে পরামর্শ নেওয়া জরুরি। বিশেষ করে:
-
যদি মুখের ভিতরে ইনফেকশন থাকে
-
অ্যাসিড রিফ্লাক্স বা GERD থাকে
-
যদি দাঁত পরিষ্কার রাখতে সমস্যা হয়
-
বমি বমি ভাব ছাড়াও মাথা ঘোরা বা বমি হয়
চিকিৎসক প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও চিকিৎসা দিয়ে সমস্যা সমাধানে সাহায্য করতে পারবেন ।
🧠 মানসিক প্রস্তুতি
মনে রাখবেন—ব্রাশ করা একটি স্বাভাবিক দৈনন্দিন কাজ। এটি নিয়ে ভয় বা আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। যদি সমস্যা মানসিক হয়, তাহলে ধীরে ধীরে ব্রাশ করার সময় আনন্দ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করুন। অনেকে হালকা হিউমার, গান, কিংবা পছন্দের কিছু ভাবার মাধ্যমে এই অস্বস্তিকর অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন।
🔚 উপসংহার
ব্রাশ করার সময় বমি বমি ভাব হওয়া অনেকের কাছে অস্বাভাবিক মনে হলেও, এটি বেশ সাধারণ এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিরীহ। কিছু সহজ অভ্যাস এবং সচেতনতার মাধ্যমে এই সমস্যাটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যদি উপরের উপায়গুলো কাজ না করে, তখন অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
স্বাস্থ্যকর দাঁত মানেই সুস্থ জীবন। প্রতিদিন নিয়ম করে ব্রাশ করুন, মুখ পরিষ্কার রাখুন এবং নিজের প্রতি যত্নবান হোন।