বাংলাদেশে বেকারত্বের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশে বেকারত্বের চিত্র দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বেকার যুবকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য মতে, দেশে বেকারত্বের হার প্রায় ৪.২% হলেও বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ। অনেকেই আংশিক বেকার বা লুকানো বেকার হিসেবে থেকে যাচ্ছেন যাদের চাকরি আছে বটে, কিন্তু দক্ষতার তুলনায় আয় বা কাজের মান খুবই নিম্নমানের।
শহর এবং গ্রাম—দুই স্থানেই বেকারত্বের ভিন্ন ভিন্ন চিত্র লক্ষ্য করা যায়। শহরে শিক্ষিত তরুণরা চাকরির সুযোগ না পেয়ে হতাশায় ভুগছেন, অন্যদিকে গ্রামে কৃষিভিত্তিক কাজের অভাব এবং কৃষিখাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও সীমিত হচ্ছে।
বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য বলছে, বাংলাদেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে অন্তত দ্বিগুণ। কারণ বহু মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নামমাত্র আয়ের কিছু কাজ করছেন যা প্রকৃতপক্ষে স্থায়ী বা সম্মানজনক চাকরি নয়।
এছাড়া, করোনা মহামারির প্রভাবে বহু মানুষ তাদের কাজ হারিয়েছেন এবং এখনও সেই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। বিশেষত গার্মেন্টস, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও হসপিটালিটি খাতের শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা ও এর প্রভাব
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা একদিকে যেমন ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষার্থী তৈরি করছে, অন্যদিকে সেই শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনের জন্য যথাযথ দক্ষতা বা যোগ্যতা তৈরি করতে পারছে না। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা মূলত পরীক্ষানির্ভর এবং মুখস্থবিদ্যা কেন্দ্রিক। ফলে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধানে অদক্ষ থেকে যাচ্ছেন।
চাকরির বাজারে যে ধরনের দক্ষতার চাহিদা রয়েছে—যেমন আইটি, ডিজিটাল মার্কেটিং, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা—তা দেশের প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতিতে খুব কমই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে একদিকে যেমন শিক্ষিত বেকার তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে উদ্যোক্তা বা আত্মনির্ভরশীল হতে শিক্ষার্থীরা প্রস্তুত হতে পারছে না।
বিভিন্ন সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ছাত্রছাত্রীদের বড় একটি অংশ স্নাতক শেষ করার পরও চাকরির বাজারের জন্য উপযুক্ত নয়। কারণ তাদের মধ্যে সফট স্কিল যেমন যোগাযোগ, দলগত কাজের সক্ষমতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা—এসবের চরম অভাব রয়েছে।
আরও সমস্যা হলো, দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কারিগরি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের সুযোগ সীমিত। অনেক ছাত্রছাত্রীর কাছে এই শিক্ষা এখনো লজ্জার বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়, যা একেবারেই ভুল ধারণা। অথচ এই খাতগুলোতে দক্ষতা অর্জন করলে সহজেই স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক চাকরির বাজারে প্রবেশ করা সম্ভব।
অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা
বাংলাদেশে জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, সেই হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিবছর লাখ লাখ তরুণ কর্মবাজারে প্রবেশ করছে কিন্তু তাদের জন্য উপযুক্ত কাজের ব্যবস্থা হচ্ছে না। ফলে তারা বেকার থেকে যাচ্ছে বা অল্প আয়ের কোনো কাজে যুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে যা তাদের যোগ্যতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
গ্রামীণ এলাকায় কৃষিভিত্তিক কাজের পরিধি দিন দিন সীমিত হচ্ছে। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ও যান্ত্রিকীকরণের ফলে শ্রমের চাহিদা কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে শহরে জনসংখ্যার চাপ এত বেশি যে নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য।
অতিরিক্ত জনসংখ্যা দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপরও চাপ সৃষ্টি করছে। সীমিত সম্পদ দিয়ে সবার জন্য কাজের ব্যবস্থা করা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এতে দরিদ্রতা আরও চরমে উঠছে এবং সামাজিক অস্থিরতাও বাড়ছে।
শিল্পখাত ও উৎপাদনশীল খাতের সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশে শিল্পখাত বা উৎপাদনশীল খাত যথেষ্ট গতিতে বিস্তার লাভ করছে না। নতুন নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপনের হার অত্যন্ত ধীর। ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগও সীমিত থেকে যাচ্ছে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যেমন পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না পাওয়া, সরকারি নীতির জটিলতা, করের উচ্চ হার, ব্যাংক ঋণ পাওয়ার জটিলতা ইত্যাদি কারণে অনেকেই উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী হলেও সাহস করতে পারছেন না।
এছাড়া দেশি পণ্যের বাজার আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে না পারায় শিল্পখাতের প্রসার সীমিত থেকে যাচ্ছে। বিদেশি পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা টিকে থাকতে পারছেন না। এতে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ কমে যাচ্ছে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রযুক্তি ও অটোমেশনের প্রভাব
প্রযুক্তির উন্নয়ন যেমন দেশের অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এটি বেকারত্ব বৃদ্ধির অন্যতম কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছে। অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের ব্যবহার বিভিন্ন খাতে শ্রমিকের চাহিদা কমিয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে শিল্পখাত ও সেবাখাতে অনেক কাজ যেখানে আগে মানুষের শ্রম প্রয়োজন হতো, এখন সেখানে মেশিনের মাধ্যমে কাজ সম্পন্ন হচ্ছে।
অটোমেশনের ফলে একদিকে কাজের গুণগতমান ও উৎপাদনশীলতা বেড়েছে, কিন্তু অন্যদিকে শ্রমিকদের চাকরি হারানোর ঝুঁকিও বেড়েছে। যেসব শ্রমিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে জানেন না বা নতুন দক্ষতা অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন, তারা সহজেই কর্মহীন হয়ে পড়ছেন।
প্রযুক্তি-নির্ভর চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে হলে নতুন ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন। যেমন কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডেটা অ্যানালিটিক্স ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ না পেলে বেকারত্ব কাটানো সম্ভব নয়।
নারী ও তরুণদের বেকারত্বের চিত্র
বাংলাদেশের বেকারত্ব সমস্যায় নারী ও তরুণরা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। বিশেষত শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ক্রমেই বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ থেকে ডিগ্রি অর্জনের পরও তারা প্রত্যাশিত চাকরি খুঁজে পাচ্ছেন না। এর পেছনে রয়েছে চাকরির বাজারে বাস্তব দক্ষতার অভাব, পর্যাপ্ত নতুন চাকরির সুযোগ না থাকা এবং চাকরির ধরন ও বেতন কাঠামোর অসঙ্গতি।
নারীদের ক্ষেত্রে বেকারত্বের চিত্র আরও জটিল। সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি, নিরাপত্তার অভাব এবং পরিবারিক সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক নারী চাকরির সুযোগ পেলেও কাজে যোগ দিতে পারছেন না। অনেক ক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য তাদেরকে নিরুৎসাহিত করছে। ফলে নারী শ্রমশক্তি দেশের মোট শ্রমশক্তির তুলনায় যথেষ্ট কম ব্যবহার হচ্ছে।
যদি আমরা তরুণদের বেকারত্বের চিত্র দেখি, তাহলে দেখা যাবে—প্রতি বছর লাখ লাখ তরুণ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে, কিন্তু তাদের মধ্যে বড় অংশই বেকার থাকছে বা অস্থায়ী কম বেতনের কাজে যুক্ত হচ্ছে। বিশেষ করে আইটি, ই-কমার্স, ডিজিটাল মার্কেটিং, ফ্রিল্যান্সিং—এই খাতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও সুযোগ না পাওয়ায় তারা পিছিয়ে থাকছে।
এছাড়া নারীদের জন্য গার্মেন্টস খাত একসময় বড় নিয়োগ ক্ষেত্র হলেও বর্তমানে সেই খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে আসছে। এর কারণ, গার্মেন্টস শিল্পে অটোমেশনের প্রভাব এবং আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার পরিবর্তন। ফলে নারী শ্রমিকদের নতুন দক্ষতা অর্জনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে।
প্রবাসে কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিটেন্স একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রবাসে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, স্থানীয় জনশক্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া, ভিসা নীতির কঠোরতা ইত্যাদির কারণে বাংলাদেশের শ্রমিকরা আগের মতো সহজে বিদেশে কাজের সুযোগ পাচ্ছেন না।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো, যেসব শ্রমিক বিদেশে যেতে চান, তাদের মধ্যে অনেকের নেই প্রয়োজনীয় দক্ষতা বা ভাষাজ্ঞান। ফলে তারা ভালো বেতনের চাকরির জন্য প্রতিযোগিতা করতে ব্যর্থ হন। আবার যারা দক্ষ, তারা নানা ধরনের এজেন্ট ও দালাল চক্রের প্রতারণার শিকার হন, যা তাদের প্রবাসে কাজের স্বপ্ন ভেঙে দেয়।
রেমিটেন্সের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। কারণ বৈদেশিক চাকরির বাজারে সামান্য ধাক্কা লাগলেই দেশীয় অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ে। তাই স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকে জোর দেওয়া এখন সময়ের দাবি।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও এর প্রভাব
বাংলাদেশের বেকারত্ব বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল না হলে দেশের ভেতরে বা বাইরে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে অনাগ্রহী হন। ফলে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে না, কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হয় না।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে প্রায়ই দেশে hartal, অবরোধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়, যা ব্যবসা-বাণিজ্যকে ব্যাহত করে। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাদের ব্যবসা টিকে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ে, আর নতুন নিয়োগ দেওয়া তো দূরের কথা, পুরোনো কর্মীদের বেতন দেওয়াই কঠিন হয়ে যায়।
সরকারের নীতি ও পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা না থাকায় দীর্ঘমেয়াদী কোনো কর্মসংস্থান নীতি বাস্তবায়িত হয় না। এক সরকার শুরু করে, অন্য সরকার এসে থামিয়ে দেয়—এভাবে প্রকল্পগুলো মাঝপথে থেমে যায় এবং দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে বেকারত্বের হার কমানো দূরের কথা, তা আরও বেড়ে যায়।
অর্থনীতিতে বৈষম্য ও আয়ের অসাম্য
বাংলাদেশে আয়ের বৈষম্য ক্রমশ বাড়ছে। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। ধনী শ্রেণি আরও ধনী হচ্ছে আর দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত শ্রেণি নানা সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে। এই আয়ের বৈষম্য বেকারত্বের সমস্যাকে আরও প্রকট করছে।
আয় ও সম্পদের বণ্টনের অসাম্য সমাজে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করছে। গরিব পরিবারগুলোর তরুণরা প্রায়ই শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় বা পড়াশোনা শেষ করার আগেই জীবিকার তাগিদে অল্প আয়ের কাজে ঢুকে পড়ে। ফলে তারা দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পায় না এবং আজীবন অল্প আয়ের কাজেই আটকে থাকে।
অন্যদিকে ধনী পরিবারের সন্তানরা ভালো শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সুযোগ সুবিধা পেয়ে সহজেই চাকরির বাজারে ভালো অবস্থান তৈরি করে নেয়। ফলে সমাজে বৈষম্য আরও বাড়তে থাকে এবং বেকারত্বের বোঝা মূলত দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপরই পড়ে।
নতুন উদ্যোক্তা তৈরি না হওয়ার কারণ
বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা এখনও খুব বেশি গড়ে ওঠেনি। একদিকে যেমন মূলধন জোগাড়ের সমস্যায় তারা জর্জরিত, অন্যদিকে সমাজে চাকরি পাওয়াকে এখনও বেশি মর্যাদার মনে করা হয়। ফলে অনেকেই ঝুঁকি নিতে চান না।
উদ্যোক্তা হতে চাইলেও তারা নানা প্রশাসনিক জটিলতা, করের বোঝা, ব্যাংক ঋণের জটিল শর্ত এবং সরকারি সহায়তার ঘাটতিতে পিছিয়ে যান। স্টার্টআপ বা নতুন ব্যবসার ক্ষেত্রে দেশে সঠিক সহায়ক পরিবেশ গড়ে ওঠেনি বললেই চলে। এতে করে অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ তাদের স্বপ্নের উদ্যোগ শুরু করার আগেই থেমে যান।
উদ্যোক্তাদের জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ, প্রশিক্ষণ, মেন্টরশিপ বা নেটওয়ার্কিং সুবিধাও দেশে সীমিত। ফলে যারা নতুন কিছু করতে চায়, তারা বিদেশমুখী হয়ে পড়ে বা বেকার থেকে যায়।
চাকরির বাজারে দক্ষতার অভাব
বাংলাদেশের বেকারত্বের অন্যতম বড় কারণ হলো চাকরির বাজারে দক্ষতার ঘাটতি। আমাদের দেশে প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক সম্পন্ন করছে, কিন্তু তারা অধিকাংশই চাকরির বাজারের প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। শুধু ডিগ্রি থাকলেই চাকরি পাওয়া যায় না, প্রয়োজন সময়োপযোগী দক্ষতা এবং বাস্তব জ্ঞান।
প্রযুক্তি, যোগাযোগ, সমস্যা সমাধান, দলগত কাজের সক্ষমতা, প্রেজেন্টেশন স্কিল—এই সব ক্ষেত্রেই তরুণদের মধ্যে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে সফট স্কিলের অভাব তাদের চাকরির বাজারে টিকে থাকতে বা ভালো পজিশন পেতে বাঁধা সৃষ্টি করছে।
প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্রগুলো শহরভিত্তিক এবং সেগুলোতে সঠিক মানের প্রশিক্ষণও সব সময় দেওয়া হয় না। ফলে যারা গ্রামের বা মফস্বলের শিক্ষার্থী, তারা এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকে।
অন্যদিকে, দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের পর্যাপ্ত দক্ষতা না থাকায় বিদেশি বিশেষজ্ঞ বা বিদেশি প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এতে করে স্থানীয় তরুণদের জন্য চাকরির সুযোগ সীমিত হয়ে যাচ্ছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন, খরা প্রভৃতি নিয়মিতই দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কৃষি খাত, যা দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবিকার মূল ভিত্তি, সেটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কৃষি জমির উৎপাদনশীলতা কমছে। অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে চাষাবাদে। ফলে কৃষিনির্ভর পরিবারগুলো ক্রমেই অন্য খাতের দিকে ঝুঁকছে, কিন্তু সেই খাতে প্রয়োজনীয় কাজের সুযোগ না থাকায় তারা বেকার থেকে যাচ্ছে।
উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের বহু মানুষ নদীভাঙন ও লবণাক্ততার কারণে ভিটেমাটি হারিয়ে কাজের আশায় শহরমুখী হচ্ছেন। কিন্তু শহরের কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতার কারণে তারা রিকশাচালক, দিনমজুর বা অস্থায়ী শ্রমিকের মতো অনিরাপদ পেশায় যুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে বেকারত্বের সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নগর দরিদ্রতার নতুন চিত্র।
চলমান অর্থনৈতিক সংকট
বাংলাদেশ বর্তমানে নানা ধরনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক ঋণের চাপ, রপ্তানি আয়ে স্থবিরতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ঘাটতি—সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
মুদ্রাস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু আয় বাড়ছে না। ফলে চাকরির বাজারে চাহিদা থাকলেও বেতন কাঠামো তেমন বাড়ছে না। নতুন বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়ছে। উদ্যোক্তারা ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। ফলে নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রও তৈরি হচ্ছে না।
সরকারি প্রকল্পগুলোতেও অর্থের সংকটের কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। অনেক প্রকল্প শুরু হলেও মাঝপথে থেমে যাচ্ছে। এতে করে একদিকে যেমন দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে বেকারত্বের হার আরও বেড়ে যাচ্ছে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারের উদ্যোগ ও ব্যর্থতা
সরকার বিভিন্ন সময় কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য নানা প্রকল্প গ্রহণ করেছে—যেমন যুব ঋণ প্রকল্প, ১০০ দিনের কাজ, পল্লী কর্মসংস্থান প্রকল্প ইত্যাদি। কিন্তু দুর্নীতি, তদবির, প্রশাসনিক জটিলতা ও পরিকল্পনার অভাবে সেসব প্রকল্প কাঙ্ক্ষিত ফল দিতে পারেনি।
বেকার যুবকদের জন্য প্রশিক্ষণ ও স্বনির্ভর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির যে প্রতিশ্রুতি বারবার দেওয়া হয়, বাস্তবে তার বাস্তবায়ন প্রায়শই সীমিত থাকে। অনেক প্রকল্পে দেখা যায়, প্রকৃত বেকাররা সুযোগ না পেয়ে প্রভাবশালী মহল সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব সরকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগগুলোকে অকার্যকর করে তুলেছে। এক সরকারের শুরু করা প্রকল্প অন্য সরকার এসে বাতিল করে বা পরিবর্তন করে ফেলে। ফলে কোনো উদ্যোগই টেকসই কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারছে না।
সমাধানের উপায় ও করণীয়
বাংলাদেশে বেকারত্ব কমাতে হলে সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নিতে হবে। প্রথমেই শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা ডিগ্রির পাশাপাশি বাস্তব দক্ষতা অর্জন করে চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারে।
কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর সংখ্যা বাড়ানো এবং মানোন্নয়ন করতে হবে। পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকায়ও এসব সুযোগ পৌঁছে দিতে হবে যাতে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য না থাকে।
উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকার ও বেসরকারি খাতকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। স্টার্টআপ এবং নতুন ব্যবসায়িক উদ্যোগের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, পরামর্শ ও মেন্টরশিপ প্রদান করতে হবে।
নতুন শিল্প স্থাপন, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সহায়তার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় স্বচ্ছতা আনতে হবে এবং প্রশাসনিক দুর্নীতি দূর করতে হবে।
সবশেষে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় টেকসই কৃষি ও বিকল্প কর্মসংস্থানের পথ খুঁজতে হবে যাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো পুনরায় কাজের সুযোগ পায়।
বাংলাদেশে বেকারত্বের সমস্যা এক দিনে তৈরি হয়নি, তাই এর সমাধানও এক দিনে সম্ভব নয়। শিক্ষা, অর্থনীতি, শিল্প, প্রযুক্তি, সমাজ—সব ক্ষেত্রেই সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। তরুণদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করে এবং দক্ষতাভিত্তিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি করে আমরা একটি কর্মসংস্থানে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি। এখন সময় এসেছে এই সমস্যা সমাধানে ঐক্যবদ্ধ এবং বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়ার।
FAQs
১. বাংলাদেশে বেকারত্বের হার কত?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বেকারত্বের হার প্রায় ৪.২%, তবে বাস্তবে আংশিক বেকার বা লুকানো বেকারসহ হার আরও বেশি হতে পারে।
২. কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব কীভাবে বেকারত্ব কমাতে পারে?
কারিগরি শিক্ষা শিক্ষার্থীদের বাস্তবমুখী দক্ষতা দেয়, যা চাকরির বাজারে সরাসরি প্রয়োগ করা যায় এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে।
৩. নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ কীভাবে বাড়ানো যায়?
নারীর কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা, সমান বেতন, এবং ঘরে-বাইরে কাজের পরিবেশ উন্নত করে নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো সম্ভব।
৪. উদ্যোক্তা তৈরিতে প্রধান বাধাগুলো কী?
প্রধান বাধাগুলো হলো মূলধনের অভাব, প্রশাসনিক জটিলতা, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও মেন্টরশিপের অভাব এবং সামাজিকভাবে চাকরিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া।
৫. প্রযুক্তি ও অটোমেশন কীভাবে বেকারত্ব বাড়াচ্ছে?
অটোমেশনের কারণে যেসব কাজ আগে মানুষের শ্রমে হতো, তা এখন মেশিনের মাধ্যমে হচ্ছে। এতে বিশেষ দক্ষতা ছাড়া সাধারণ শ্রমিকদের চাকরি হারানোর ঝুঁকি বাড়ছে।